মানুষের ভাগ্য কখন লেখা হয়? জন্মের আগে না জন্মের পরে?

একজন মুমিনের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত তাকদির বা ভাগ্যের ওপর বিশ্বাস রাখা ফরজ। মুমিন বিশ্বাস করে—সৃষ্টিজগতে যা কিছু ঘটে, তা আল্লাহ তাআলার পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে—

“পৃথিবীতে অথবা তোমাদের ব্যক্তিগত জীবনে যে কোনো বিপর্যয় ঘটে, আমি তা সংঘটিত করার আগেই তা লিখে রেখেছি; আল্লাহর জন্য এটি অতি সহজ।”
— (সুরা হাদীদ, আয়াত : ২২)

তাকদির বা ভাগ্য মূলত চারটি পর্যায়ে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে। নিচে সে চারটি ধাপে আলোচনা করা হলো:

ভাগ্য কখন লিপিবদ্ধ হয়

তাকদির বা ভাগ্য একটি গভীর ও ঈমানি বিষয়, যা ইসলামী বিশ্বাসের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলোর একটি। একজন মুমিনের জীবনে তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস রাখা যেমন অপরিহার্য, তেমনি তা তাঁর মন-মানসিকতা ও জীবনচলার পথকে প্রভাবিত করে। আমরা প্রায়শই জীবনের বিভিন্ন ঘটনায় হতাশ, ভীত বা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি, কারণ আমরা বুঝতে পারি না—সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছা ও জ্ঞানের অধীনে ঘটে। এই প্রবন্ধে কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে আমরা জানব, আল্লাহ কখন এবং কীভাবে আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। সেইসাথে তাকদিরে ঈমান আনার উপকারিতা ও এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা করা হবে, যাতে পাঠকের মনে এ বিষয়ে একটি পরিপূর্ণ ও সঠিক ধারণা জন্মে।


১. সৃষ্টিজগতের পূর্বে

তাকদির নির্ধারণের প্রথম ধাপ হলো—জগত সৃষ্টির বহু পূর্বে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আসমান ও জমিন সৃষ্টি করার ৫০ হাজার বছর আগে সব সৃষ্টির তাকদির লিখে রেখেছেন।”
— (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৯১৯)

আরেকটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে—

“আল্লাহ প্রথমে কলম সৃষ্টি করেন। অতঃপর তাকে বলেন, ‘লিখো’। তখন কলম লিখে ফেলে—যা কিছু ঘটেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, সব কিছু।”
— (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২৭০৫)


২. মাতৃগর্ভে

তাকদিরের দ্বিতীয় ধাপটি ঘটে গর্ভে, ভ্রূণের বিকাশকালীন সময়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—

“ভ্রূণ মাংসপিণ্ডে পরিণত হলে, একজন ফেরেশতা প্রেরণ করা হয়, যে তার মধ্যে রুহ (প্রাণ) ফুঁকে দেন এবং তার জীবিকা, আয়ু, আমল ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য লিখে ফেলেন।”
— (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২০৮)


৩. লাইলাতুল কদরে

প্রতি বছর লাইলাতুল কদরে বা কদরের রাতে এক বছরের ঘটনাপঞ্জি নির্ধারিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন—

“এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।”
— (সুরা আদ-দুখান, আয়াত : ৪)


৪. প্রতিদিন

চতুর্থ ধাপে প্রতিদিনের ঘটনাপুঞ্জ আল্লাহর ইচ্ছায় সংঘটিত হয়। প্রতিদিন বান্দার জীবনে কী ঘটবে, তা আল্লাহর জ্ঞানের পরিধির মধ্যেই পূর্বনির্ধারিত থাকে। কোরআনে বলা হয়েছে—

“তিনি প্রতিদিন কোনো না কোনো কাজে রত।”
— (সুরা আর-রাহমান, আয়াত : ২৯)


ভাগ্যে বিশ্বাসের উপকারিতা

তাকদিরে বিশ্বাস একজন মুমিনের মনে আত্মপ্রত্যয়, ধৈর্য ও আল্লাহর ওপর ভরসা সৃষ্টি করে। এই বিশ্বাস তাকে দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা থেকে মুক্ত রাখে। কারণ, যে ব্যক্তি জানে—তার জীবনে যা ঘটে, তা আল্লাহর নির্ধারিত পরিকল্পনার অংশ, সে কোনো বিপদে হতাশ হয় না এবং কোনো প্রাপ্তিতে অহংকারেও ভোগে না।

পবিত্র কোরআনে এসেছে—

“বলুন! আল্লাহ যা আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন, তা ছাড়া কিছুই আমাদের স্পর্শ করবে না।”
— (সুরা তাওবা, আয়াত : ৫১)


তাকদিরে ঈমানের মূলভাব

তাকদিরে ঈমান আনার অর্থ হলো—এ বিশ্বাস রাখা যে আল্লাহই একমাত্র উপকার ও ক্ষতির মালিক, তিনিই সবকিছু দান ও প্রত্যাহার করার ক্ষমতার অধিকারী। এই বিশ্বাস একজন বান্দার মনে আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও নির্ভরতাবোধ সৃষ্টি করে। ফলে সে শুধু আল্লাহর নির্দেশাবলির প্রতি মনোযোগী হয় এবং তাঁর সীমারেখা মেনে চলে।

ইমাম ইবনু রজব (রহ.) বলেন—

“তাকদিরে বিশ্বাস একজন মুমিনকে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আনুগত্যে দৃঢ় করে তোলে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন থেকে বিরত রাখে।”
— (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ২০/৩১)


এই লেখার সারমর্ম হলো—ভাগ্যের প্রতি সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস একজন মুমিনের অন্তরে পরিপূর্ণ প্রশান্তি এনে দেয়, তাকওয়া ও তাওয়াক্কুলে তাকে দৃঢ় করে তোলে এবং আল্লাহর ওপর একনিষ্ঠ নির্ভরশীলতার চেতনায় সে বলীয়ান হয়।

উপসংহার

তাকদির বা ভাগ্য বিশ্বাস করা শুধু একটি ধর্মীয় শিক্ষা নয়, বরং একজন মুমিনের জীবনের স্থিতি, শান্তি ও আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি। এই বিশ্বাস মানুষকে হতাশা থেকে রক্ষা করে, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ নির্ভরশীলতা অর্জনে সাহায্য করে এবং অন্তরে সন্তুষ্টির অনুভূতি জাগ্রত করে। একজন মুমিন জানে, জীবনের প্রতিটি ঘটনা আল্লাহর নির্ধারিত পরিকল্পনার অংশ, যা কল্যাণকর বা পরীক্ষামূলক—তবে সবই তাঁর হিকমতের অন্তর্গত। তাই, আমাদের উচিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর তাকদিরের ওপর ঈমান রাখা, দোয়া করা, আমলে অটল থাকা এবং ধৈর্যের সঙ্গে চলা। কেননা, পরিশেষে সে-ই সফল, যে আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্যকে বুঝে, মানে ও তাতে সন্তুষ্ট থাকে।

Share:

Leave A Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You May Also Like